ই-বর্জ্য সমস্যার সমাধানের খোঁজে

0
1473

৬ মে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পা রেখেছি ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটির আমন্ত্রণে। উদ্দেশ্য—বাংলাদেশের ই-বর্জ্য সমস্যা নিরসনে আমাদের নেওয়া উদ্যোগ, ‘রিসাইকেল বাংলাদেশ’-এর হয়ে আন্তর্জাতিক ‘ই-ওয়েস্ট একাডেমি’তে দেশের প্রতিনিধিত্ব করা। তখন বিকেল। বিমানবন্দরে একটি প্রাইভেট কার নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আয়োজকদের একজন প্রতিনিধি। ব্যাংককে তিনিই আমাকে স্বাগত জানালেন।

সন্ধ্যার মধ্যেই চলে এসেছিল ১৯টি দেশের ৩৩ জন ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোক্তা, বিশেষজ্ঞ ও নীতিনির্ধারক। পাঁচ তারকা হোটেল আভানির পাশেই অবস্থিত হোটেল অনন্তারার নদীসংলগ্ন ক্যাফেতে একটি অনানুষ্ঠানিক পরিচয়পর্বের আয়োজনে সবাই যোগ দেন। সেখানে আমার পরিচয় হয় আয়োজক ও অন্যান্য অতিথির সঙ্গে। প্রথমেই কথা হয় তাইওয়ানের সবচেয়ে বড় রিসাইক্লিং প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা কসমাস লি এবং সিঙ্গাপুর সরকারের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল এজেন্সির দুজন প্রতিনিধির সঙ্গে, যাঁদের একজন ছিলেন আমার সমবয়সী। ফলে দ্রুতই একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়ে যায়। সবার সঙ্গে সেদিন আর সেভাবে কথা হয়নি। পরদিন সকালে দেখা হবে ভেবে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষেই ফিরলাম হোটেল আভানির রুমে। আমার রুম থেকে পার্শ্ববর্তী নদী আর রাতের ব্যাংককের যে অপরূপ দৃশ্য দেখা যাচ্ছিল, এই দৃশ্য রেখে কিছুতেই ঘুমাতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু না, পরদিন সকাল পৌনে নয়টায় একাডেমির উদ্বোধন, তাই দ্রুতই শুয়ে পড়তে হলো।

শুয়ে শুয়ে পরদিনের সেশনের উপজীব্য বিষয়বস্তু, তথ্য-উপাত্ত এবং যে বৈশ্বিক সমস্যার টেকসই সমাধান পরিকল্পনার জন্য ব্যাংককে আসা, এসব নিয়ে ভাবছিলাম। আমাদের সবার বাসাতেই নানা ধরনের ইলেকট্রনিক এবং ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি রয়েছে। কিন্তু আমরা কয়জন জানি, আমাদের জীবনকে সহজ করে দেওয়া এই যন্ত্রগুলো কখনো কখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আমাদের জন্যই প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়াতে পারে। শুধু মোবাইল ফোনের কথাই যদি বিবেচনা করা হয়; গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিটি মোবাইল ফোনে গড়ে যে পরিমাণ ‘লেড’ নামক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকে, তা দিয়ে প্রায় ৪৫ হাজার গ্যালন পানি দূষিত করা সম্ভব। তা ছাড়া মোবাইল ফোনে আরও অনেকগুলো ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান থাকে, যেমন ক্যাডমিয়াম, মার্কারি, আর্সেনিক, ক্লোরিন ইত্যাদি যা কিনা যথাযথ ব্যবস্থাপনার অভাবে পানি বা মাটিতে চলে যায়। পরিবেশ দূষিত করে এবং আমাদের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। মোবাইল ফোন ছাড়াও, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাবলেট থেকে শুরু করে আমাদের বাসার টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, রিমোট ইত্যাদি যন্ত্র এই ভয়ংকর পরিবেশ দূষণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্য দায়ী। বাংলাদেশ প্রতিবছর কয়েক মিলিয়ন মেট্রিক টন ই-বর্জ্য উৎপাদন করে, যার প্রায় পুরোটাই চলে যায় এলাকার অদক্ষ ও প্রশিক্ষণহীন ভাঙারির দোকানে। ভাঙারির দোকানদারেরা বাসা ও অফিস থেকে পুরোনো, নষ্ট যন্ত্রগুলো কিনে নেন এবং নিয়মবহির্ভূত উপায়ে এগুলো নিয়ে কাজ করেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্তু ও ধাতব কৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়ার সময় থেকেই আমি আর আমার বন্ধু ইমরান নূর ই-বর্জ্য নিয়ে কাজ করছি। ভাবছিলাম, কীভাবে আমাদের দেশের সমস্যাগুলো অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়া যায়। ই-বর্জ্যের সমস্যা তো শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের।

সকালে যখন চোখ মেলেছি, তখন ঘড়িতে সাড়ে আটটা বাজে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে, প্রস্তুতি নিয়ে চলে গেলাম হোটেল আভানির দশম তলায় অবস্থিত কনফারেন্স রুমে। সবার কাছে নিজের পরিচয় দিয়েই শুরু হলো অংশগ্রহণ। এরপর একে একে বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞ ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের সেশন শুরু হয়। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কী পরিমাণ ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, কীভাবে সেগুলোর ব্যবস্থাপনা করা হয়, ব্যবস্থাপনার আদর্শ পদ্ধতি কী, বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে সরকারের কী কী নীতিমালা আছে, কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে—এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল। আলোচনা, পরামর্শ, পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই দুদিন চলে গেল।

বুধবারে ছিল ফুজি জেরক্স ইকো ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির কারখানায় আমাদের পূর্বনির্ধারিত শিক্ষাসফর। দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে সেখানে যেতে হয়। ঘুরে ঘুরে তাঁদের ব্যবস্থাপনা দেখা আমার জন্যও সত্যিই একটা শিক্ষাসফর ছিল বটে! পরের দুদিন আমরা বিভিন্ন ধরনের ই-বর্জ্য ও তাদের ক্ষতিকর দিকবিষয়ক সেশনে অংশগ্রহণ করি। ঘানা, ভারত ও সুইজারল্যান্ডের নীতিমালা ও বাস্তবায়ন নিয়ে পর্যালোচনা করি। এর মধ্য দিয়েই আমরা শিখেছি, কীভাবে জাতীয় পর্যায়ে এই সমস্যার নিরসনে নীতিমালা তৈরি করতে হয় এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা যায়। শুক্রবার একডেমির সমাপ্তি হয়। শনিবার বিকেল ৬টায় ঝুলিভর্তি অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে আসি, আরও জোরালোভাবে ই-বর্জ্য নিরসনে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here