রণাঙ্গনের যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্র বদল বা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, কিন্তু সমাজ বদলের যুদ্ধের প্রকৃতি ভিন্ন। তার রণাঙ্গন যেমন সমাজ-বাস্তবতার উপরিকাঠামোয় ছড়ানো, তেমনি সমাজমানসের অন্দরজুড়েও বিস্তৃত। স্বভাবতই কাজটা কঠিন। ১৯৭১-এ আমরা নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন করেছি, কিন্তু সমাজমানস রয়ে গেল পুরোনো আদলে। তবু এটি মুক্তির সংগ্রাম ছিল বলে এ সময় পাকিস্তানবিরোধী বক্তব্যের চেয়েও আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন বড় ছিল। এ আন্দোলনের মেরুদণ্ড ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এর মূল উপাদান উদার মানবতাবাদ, যা সহজাতভাবে অসাম্প্রদায়িক, সম্মিলনকামী। সঙ্গে ছিল গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের অঙ্গীকার। এগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম হলেও উভয়েরই সামাজিক ভূমিকা ও প্রভাব ব্যাপক।

সমাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের ওপরই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বিকাশ নির্ভরশীল। একই কথা খাটে সমাজতন্ত্রের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের তিনটি ঘোষিত আদর্শের মৌলিক নীতিরই অন্তর্নিহিত প্রণোদনা ধর্মনিরপেক্ষ, যা আমাদের চতুর্থ মূল নীতি ছিল। বাঙালির চিরায়ত ভাবাদর্শের মানবিক প্রণোদনার কারণেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক। আবার গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের সব জনগণ আইনের চোখে সমান, দায়িত্ব ও অধিকারে
কোনো তারতম্য থাকার কথা নয়। তার সঙ্গে সমাজতন্ত্র যুক্ত হলে প্রত্যেক নাগরিকের বৈষয়িক প্রাপ্তির ন্যায্যতা ও সমতা নিশ্চিত হয়। এভাবে এরও অন্তর্নিহিত আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষ।

রাষ্ট্রের ও আমাদের রাজনীতির এই নতুন অর্জনগুলো কেবল রাজনৈতিক কর্মসূচি বা বক্তব্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয় ছিল না। একসময় গ্রামীণ জীবন যৌথ যাপনের ওপর নির্ভরশীল ছিল, তাদের জীবনসংগ্রাম এবং জীবনযাপন ও উদ্‌যাপন সবার সহযোগিতায় সার্থকতা পেত। তাই এ সমাজের নিম্নবর্গ দারিদ্র্যপীড়িত হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ছিল উদার ও মানবিক। কিন্তু ক্রমেই নগরজীবনের প্রাধান্য বাড়ল, সমাজের চেয়ে রাষ্ট্র প্রধান হয়ে উঠল, রাজনীতি সংস্কৃতির চেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকা নিল।

গ্রামীণ সমাজে জমিদার ও উচ্চবর্ণের প্রাধান্য ছিল, বৈষম্য ও শোষণ ছিল, তার বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে প্রজার বিদ্রোহও ঘটেছে। কিন্তু বৃহত্তর সমাজে অর্থাৎ নিচতলার সমাজে একধরনের সাম্যের আবহে উদার মানবতার চর্চা হয়েছে। কিন্তু নগর, রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্রম-প্রাধান্যের ফলে যে রূপান্তর, তাতে নতুন ÿক্ষমতাবান গোষ্ঠীর উত্থান হলো, এ ব্যবস্থায় রাজনীতি ও বাণিজ্য জোটবদ্ধ হয়েছে। তাদের দৌরাত্ম্যে সমাজে দুর্নীতি ও অপরাধ ছড়িয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতায় সমাজমানসের বিকাশ অসম্ভব হয়ে পড়ে। সমাজমানসের বিকাশের জন্য চাই অবাধ জ্ঞানচর্চা, উচ্চতর গবেষণা, সৃজনশীলতার মুক্ত পরিবেশ ও পর্যাপ্ত সুযোগ। এর জন্য পুরোনো চিন্তা, বিশ্বাস, অভ্যাসের অচলায়তনকে চ্যালেঞ্জ জানানোর, খারিজ করার, সংশোধনের, নতুন কথা বলার মতো পরিবেশ প্রয়োজন। অন্ধবিশ্বাস‌‌, অভ্যস্ত চিন্তা, গতানুগতিক আচারের পক্ষে শক্তিশালী ক্ষমতাবান গোষ্ঠী আছে। তাই সমাজ পরিবর্তনের কাজে যেমন চাই মেধার মৌলিক ব্যবহারের ÿক্ষমতা, তেমনি প্রয়োজন প্রচলিত অন্ধতার প্রাচীর ভাঙার সাহস।

এ সমাজে ব্যক্তিগত সম্পদ ও বিত্তবৈভব অর্জনে বেপরোয়া প্রচেষ্টা ছড়িয়ে পড়েছে। তরুণসমাজও এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের রাজনীতি এখন চিন্তা ও চেতনায় সম্পূর্ণ আপসকামী। উচ্চতর শিক্ষাঙ্গনসহ সমগ্র শিক্ষাঙ্গন অত্যন্ত গতানুগতিক ধারায় ডিগ্রি ও সনদের যূপকাষ্ঠে মাথা পেতে রেখেছে। সাহসী ভাবুক, চমকে দেওয়ার মতো নতুন চিন্তকের দেখা নেই। যাঁরা টিমটিম করে জ্বলছেন তাঁরা সত্যিই নিঃসঙ্গ, সচেতনভাবে তাঁদের কাজ থেকে দূরে রাখা হয়। কেউ কেউ তাতেও নিবৃত্ত না হলে তাঁদের কাজে বাধার সৃষ্টি করা হয়, তাঁদের অকেজো করে রাখা হয়।

এ রকম সমাজে ব্যক্তির উত্থান, নাগরিক হিসেবে মর্যাদা নিয়ে স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সব মানুষ তো নীতি-রুচি-অঙ্গীকার নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত থাকেন না, পরিবারের ভাবনায় কাতর সংসারীর কাছ থেকে তা প্রত্যাশাও করা যায় না। কিন্তু সব মানুষ সংসারের জালে আটকে পড়লে সে সমাজের সম্ভাবনা ফুরিয়ে যায়। আমাদের সমাজে বহুকাল ধরেই পরিবর্তনের চাবিকাঠির ভূমিকায় আছে ছাত্র-তরুণেরা। আশঙ্কার কথা হলো, পুঁজিবাদের পণ্যাসক্তি ও ভোগবাদিতার মোহও তো কম শক্তিশালী নয়। তা যদি শৈশব থেকেই প্রভাবিত করতে থাকে এবং ভাবনা-কল্পনা ও সৃজনশীলতার অবকাশ না রাখে, তাহলে তারুণ্যের সর্বনাশ ঠেকানো মুশকিল। তারুণ্যের অপচয় মানে সমাজের পচন। তার লক্ষণ সমাজদেহে যথেষ্টই প্রকাশ পাচ্ছে।

সড়ক মেরামতের কথা আমরা ভাবি, সেতু নির্মাণের দাবি তুলতে পারি, মেট্রোরেল বা বড় বড় স্থাপনার পরিকল্পনা করি। এসব কাজ সমাজ ও রাষ্ট্র একযোগেই করছে। কিন্তু জ্ঞানে, দক্ষতায়, মানসিকতায় উন্নত মানুষ তৈরির কথা কেউ ভাবি না। মূল্যবোধের সংকট, মানবিক চেতনার ভাটাও দেখতে পাই। এ নিয়ে আলোচনাও কম হয় না, কিন্তু ব্যাধির প্রতিকার ও অবস্থার পরিবর্তনের জন্য যথাযথ কাজ করতে পারছি না। রাষ্ট্র ও রাজনীতির অ্যাজেন্ডায় মানুষের পরিচর্যা ও উন্নত মানুষ তথা উন্নত মানবসমাজ তৈরির মতো জরুরি বিষয় নিতান্ত গতানুগতিক ভাবনায় আটকে আছে। সেটা রাষ্ট্রের কর্তাদের ভূমিকায় এবং বাজেট বরাদ্দেও প্রকাশ পায়। একটি সমাজের আগাপাছতলা যদি বিষয়-আশয়ের চিন্তায় মগ্ন থাকে তাহলে সেটা কি আর মানুষের সমাজ থাকে? এমন সমাজে অজান্তেই কখন ঘুণপোকায় পরিণত হয় মানুষ। এমন বাস্তবতায় যখন দেখি কেউ আইনের শাসনের স্বপ্ন দেখেন, তখন বুঝি এরা রবীন্দ্রনাথের সেই তরুণ বালক, যারা উন্মাদ হয়ে ‘কী যন্ত্রণায় মরিছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে’।

এর জের টেনে কি বলব, আমাদের কণ্ঠ আজ রুদ্ধ, বাঁশি সংগীতহারা? আমাদের এ সমাজ কি অমাবস্যার আঁধারে কারাতুল্য হয়ে উঠেছে? আমাদের জগৎ কি দুঃস্বপনের তলে বিলুপ্তির পথে? রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে বলতে হবে, এমন শোচনীয় বাস্তবতার কথা আমরা ভাবব না। কেননা, সমস্যাগুলো আমরা দেখতে পাচ্ছি, বুঝতেও পারছি। এবং সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখার মতো দেখতে পাচ্ছি বিশাল এক তরুণসমাজ। তারুণ্যের ক্ষমতায় এখনো আমরা বিশ্বাস রাখতে পারি; কেননা, নতুন প্রজন্মের মধ্যে চিন্তার কিছু স্বাবলম্বিতা, কিছু মৌলিকত্ব কিংবা সাহসের কিছু ভ্রূণ দেখতে পাচ্ছি। জানি, তাদের দমিয়ে, দাবিয়ে ও ভুলিয়ে রাখার অপশক্তির অভাব নেই, তবে প্রাণশক্তির সহজাত প্রবণতা যে জেগে ওঠার ও বিকাশের দিকে—সেটাই আশার কথা।

এর মধ্যেও দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো, তরুণদের বিশাল উপস্থিতি থাকলেও তার একটি শক্তি হিসেবে জাগরণের লক্ষণ আপাতত নেই। তারুণ্যের মধ্যে চিন্তার জরা, কর্মের জড়তাও লক্ষ করার মতো। কীভাবে যেন আমাদের সমাজটা ভোগের ঊর্ধ্বে উদ্‌যাপনের পর্যায়ে যেতে পারছে না। এ সমাজ
বাস্তব জীবনে নানা আধুনিক পণ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, কিন্তু এর পেছনে যে সৃজনশীলতা, যৌক্তিক চিন্তা, নিরলস বৈজ্ঞানিক গবেষণা, জিজ্ঞাসা, অনুসন্ধান, সংশয়, কৌতূহল, পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ, মূল্যায়ন ইত্যাদি কাজ করেছে, তাকে গ্রাহ্যই করছি না আমরা। এ যেন গায়েগতরে বড় হচ্ছে, স্বাস্থ্যের জৌলুশ বাড়ছে কিন্তু বুদ্ধি-কল্পনা-মনন-সৃজনে বামন হয়ে থাকার অবস্থা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশসমূহের নানা অনাচারের কথা আমরা জানি। ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তান বা ফিলিস্তিনের উদাহরণ এখনো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু তারা নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চতর গবেষণা ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রগুলোয় হস্তক্ষেপ করে না। তাদের স্বাধীন বিকাশ ও অবদান অব্যাহত আছে। তাতে রাষ্ট্রে নানা সংকট ও অবক্ষয় হলেও ব্যক্তি ও সমাজের মানবিক বিকাশ ও উত্তরণের অবকাশ ÿক্ষুণ্ন হয় না।

সত্যিই মানবসমাজ হিসেবে এগোতে হলে চিন্তাচর্চা ও সৃজনশীলতার ক্ষেত্রগুলোর স্বাধীন বিকাশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। গোড়ায় অবশ্য শিক্ষাকে ঢেলে সাজিয়ে কিশোর-তরুণদের মৌলিক চিন্তাশক্তি এবং অনুসন্ধিৎসা, উদ্যম ও সৃজনশীলতা ধরে রাখার ও লালনের দিকে নজর দিতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here