Saturday, February 8, 2025
Homeমতামতউত্তর কোরিয়া বৈঠক বাদ দিলেন ট্রাম্প, লাভ হলো চীনের

উত্তর কোরিয়া বৈঠক বাদ দিলেন ট্রাম্প, লাভ হলো চীনের

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে নির্ধারিত বৈঠক একেবারে হুট করে বাতিল করলেন। এই হঠকারী সিদ্ধান্তকে ট্রাম্পের কূটনৈতিক ব্যর্থতা, জং-উনের কূটনৈতিক অভ্যুত্থান এবং চীনের বড় বিজয় বলা যেতে পারে। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে জং-উন নিম্নবর্গীয় অচ্ছুত নেতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ একজন শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকারী আন্তর্জাতিক নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন। এই সাফল্যে মুখ দেখার সুযোগ কিমের সামনে খুব কমই ছিল। সেই সুযোগ করে দিয়েছেন ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্র একের পর এক হামলার হুমকি দিয়েছে। এমনকি চীনের মতো মিত্রদেশ পর্যন্ত কড়া অর্থনৈতিক অবরোধ চাপিয়ে দিয়েছে। এত চাপ নিয়ে উত্তর কোরিয়া শেষ পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্রধারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এমনকি এখন দেশটি একটি নৈতিক উচ্চ অবস্থানও দাবি করতে পারার জায়গায় চলে গেছে। কারণ, কিম জং–উনই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রকে ঐতিহাসিক দ্বিপক্ষীয় সম্মেলনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন; আর ট্রাম্প সেই প্রস্তাবে রাজি হয়ে কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই তা বাতিল করেছেন।

এটি প্রায় নিশ্চিত, পূর্ব এশিয়ার কেউ মনে করে না আলোচনার ইস্যুতে কিমের অবস্থানের নড়চড় হয়েছে। সবাই জানে তিনি একজন নির্দয় একনায়ক এবং আঞ্চলিক শান্তির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী লোক। কিন্তু তারপরও উত্তর কোরিয়ার প্রতিবেশী দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন এবং রাশিয়া—এদের সবার কাছে এখন ট্রাম্পের চেয়ে কিমের কথার দাম বেশি।

দীর্ঘ সময় ধরে হাজার বাধা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়া যে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করেছে, তা সহজেই সে পরিত্যাগ করবে, এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। পরমাণু নিরস্ত্রীকরণের বাইরেও উত্তর কোরিয়া এই অঞ্চলে সামরিক উত্তেজনা কমানোর জন্য যে শান্তিচুক্তি করার ও বিশদ কৌশলপত্র প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে, সেটিকে সবাই, বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন স্বাগত জানিয়েছে।

অন্যদিকে সমঝোতা নিয়ে আমেরিকার দৃশ্যমান তৎপরতার বিষয়ে ঠিক একই কথা বলা যাচ্ছে না। বৈঠক শুরুই হয়নি; অথচ তার আগেই ট্রাম্প প্রশাসন বলা শুরু করেছে, উত্তর কোরিয়ার সর্বাত্মক পরমাণু কার্যক্রম ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে ধ্বংস করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই দাবি কখনোই বাস্তবসম্মত নয়। বিনা উসকানিতে একতরফাভাবে ইরান চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে আসা এবং গাদ্দাফির আমলের লিবিয়ার সঙ্গে তুলনা করে উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের আক্রমণাত্মক কথাবার্তা যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

পশ্চিমাদের মদদপুষ্ট বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত ও তাদের হাতে নিহত লিবীয় নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির সঙ্গে কিম জং–উনকে মিলিয়ে মার্কিন কর্মকর্তারা মন্তব্য করার পর উত্তর কোরিয়া কর্কশ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এটিকে ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার ‘প্রকাশ্য ক্রোধ ও হিংসা’ উল্লেখ করে বৈঠক বাতিল করেন। তবে এতে উত্তর কোরিয়া বিন্দুমাত্র ভয় পেয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করার দাবি ট্রাম্পের পরিকল্পনার শুরুতেই ছিল কি না, সেটি এখন আর কোনো বড় বিষয় নয়। এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, এই সম্মেলন বাদ দিয়ে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্র পরিত্যাগে বাধ্য করতে কিংবা সেখানকার শাসক পরিবর্তন করতে যুক্তরাষ্ট্র
কী কী করতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদার দেশগুলো কীভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানাবে, তার ওপরই এর উত্তর নির্ভর করছে।

উত্তর কোরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় মিত্র জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে কোনো রকম কোনো আলোচনা ছাড়াই ট্রাম্প বৈঠক বাতিল করায় দেশ দুটি উপেক্ষিত ও প্রতারিত বোধ করেছে। ট্রাম্প বৈঠক বাতিল করার পর উত্তর কোরিয়া তার নৈতিক ভিত শক্ত করার সুযোগ পেয়েছে। সে বলেছে, পিয়ংইয়ং যেকোনো সময় আলোচনা করতে রাজি আছে। এই ঘোষণার মুখে ট্রাম্প আবার বৈঠক করা যেতে পারে বলে একটি বিভ্রান্তিকর বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু চীন কী প্রতিক্রিয়া দেবে, সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

উত্তর কোরিয়া চীনের মিত্রদেশ ও গুরুত্বপূর্ণ ‘ক্লায়েন্ট’। তা সত্ত্বেও উত্তর কোরিয়ার ওপর কড়া অবরোধ জারি রাখার ব্যাপারে আমেরিকার নেওয়া অবস্থানকে সমর্থন করেছে শুধু এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষার কথা ভেবে। অতি সম্প্রতি দুই মাসের কম সময়ের ব্যবধানে কিম জং–উন দুবার চীন সফর করেছেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা হিসেবে এটিই ছিল কিমের প্রথম বিদেশ সফর। এই সফরের মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়েছেন, চীনের নেতা সি চিন পিংয়ের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ আছে এবং তিনি চিন পিংয়ের কূটনৈতিক মদদ চান।

এখন যেহেতু ট্রাম্প কাউকে কিছু না বলেই সম্মেলন বাতিল করেছেন, সেহেতু উত্তর কোরিয়ার ওপর চীন চাপ অব্যাহত রাখার তেমন কোনো যুক্তি খুঁজে পাবে না। আসলে এই বৈঠক বাতিল করে ট্রাম্প চীনকে দুটি ঈর্ষণীয় বিষয়ের যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়ার পথ খুলে দিয়েছেন। এখন চীন চাইলে উত্তর কোরিয়া ইস্যুকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার চলমান বাণিজ্যিক সম্পর্কে নতুন করে দর-কষাকষি করতে পারবে। অথবা চীন আবার আগের মতো উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করতে পারে এবং এর মাধ্যমে কিম জং–উনকে বুঝিয়ে দিতে পারে, উত্তর কোরিয়া চীনের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপান উভয়েই উত্তর কোরিয়া ও ইরান চুক্তি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কাজ–কারবারের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের দাবি মেনে নেওয়ার বিষয়ে চীন এখন আর আগের মতো আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নেই। যুক্তরাষ্ট্র এখন উত্তর কোরিয়ার ওপর হামলা করে বসে কি না, সেটিই এখন চীনের মাথাব্যথার বড় কারণ; যদিও সেই আশঙ্কা এখনো বহু দূরে বলেই মনে হচ্ছে।

কোরীয় উপদ্বীপ এলাকায় এখন যুদ্ধ ছাড়া আর যা ঘটবে, তাতেই চীনের লাভ। এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা রক্ষায় সে এখন আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। চীন এই অঞ্চলে যেটিই করবে, সেটিকেই যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় বেশি যৌক্তিক কাজ বলে মনে করা হবে। ট্রাম্পের এই বৈঠক বাতিলের মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমল এবং চীনের প্রভাব বাড়ার গতি আরও বেগবান হলো।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments